« নীড়পাতা

মৃত্যুর শহর



নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সংগ্রামী মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও নব্য ধনীক শ্রেণীর পারষ্পরিক ব্যবধান-বৈষম্যের মাঝে মুকিতের বসবাস। মাস্টার্সে থার্ডক্লাস পেয়েও বিচলিত নয় সে; বরং বাইশ বছরের শীর্ণ শরীর আর প্রত্যয় নিয়ে প্রচলিত সিস্টেমকে পালটে দেয়ার স্বপ্ন দেখে অবিরাম। আমাদের চিরচেনা শহরের পরিচিত মানুষগুলোর মুখোশ টুপটাপ খসে পড়ে মুকিতের ধারালো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে। বড়লোক বন্ধু শুভর ফোর রানার হুইলে চাপা পড়ে এক কবির মৃত্যু মুকিতের ভাবনাগুলো ওলট-পালট করে দেয়। মুকিতের চারপাশে ভীড় করে একবিংশের একদল উদ্ভ্রান্ত তরুণ প্রাণ; যাদের কেউ প্রেম-অপ্রেমের সাপলুডু খেলায় হতবিহবল, কেউ প্রতারিত প্রেমিক-প্রেমিকা, ব্যর্থ কবিদল, নিবেদিতপ্রাণ নাট্যকর্মী-সুবিধাবাদী নাট্যগুরু, পঁূজিবাদের পেশীর কাছে পরাজিত স্বাপ্নিক চলচ্চিত্র নির্মাতা, পদক ব্যবসায়ী অথবা পলিটিক্যাল ফিশিংয়ের হাউজ অব ডেথ পেরুনো কর্পোরেট থিংকট্যাংক আর সুশীল সমাজের ছদ্মবেশ ধরা হিংস্র সব মানুষ।

স্বচ্ছল জীবনের হাতছানিতে বিভ্রান্ত শেহনাজ-ফারাদের মোহ কাটিয়ে মুকিত বিয়ে করে ভিন্ন ধর্মের ধনীকণ্যা সিনডেরেলাকে। বিয়ের পর সামাজিক ফরম্যাটে সংসারী হওয়ার চেষ্টায় মুকিত হাঁফিয়ে উঠে। নাগরিক জীবনের উচ্ছ্বাস উতসবের পহেলা বৈশাখ, শেরাটনে সুমনের গান, সংখ্যালঘুর যন্ত্রণা, বিবৃতিবাজ বুদ্ধিজীবি, ভন্ড পলিটিশিয়ান আর রটেন অ্যাফলুয়েন্ট সোসাইটির নরম রঙীন কার্পেটের তলায় স্তর জমা নাগরিক ধুলোবালি মুকিত উন্মোচন করে দেয় এক ঝাপটায়। একঘেঁয়ে বিরক্তিকর মানুষদের ভীড়ে সহজ-সরল হারূ মিয়া কিংবা হিজড়াদের সংস্পর্শে এসে মুকিতের মনে হয় এখনো একটি আকাশ আছে, কেবল জানালা খোলার বাকী!

তারপর একদিন কবি হত্যাকারী শুভ ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে আসা উপলক্ষে শুভর বাবা উতসব আয়োজন করে; নৌ-বিহারে শহরের আলোকিত ঝলমলে মানুষদের ভীড়ে পুরনো ভাবনাগুলো আবার ফিরে এলেও তীর্থ যাত্রার আত্মসংশোধন পর্ব ভেবে মুকিত কিছুটা আশাবাদী হয়। সিনডেরেলার সাথে ভালোলাগার মুহূর্তগুলো শিহরণ জাগায়। তবে স্বপ্ন ভঙ্গ হতেও দেরী হয় না। সামাজিক দানবদের শহরে ফেরার প্রস্তুতি দেখে আশঙ্কায় মুকিতের বুক শুকিয়ে যায়। নস্টালজিয়া ঘেরা ভালোবাসার শহরে মৃত্যু দানবদের সাঁজোয়া বহরের নিচে প্রাণ দিবে কবি-পরাজিত মেঘদল-অসহায় কালো মানুষ! মুকিতের আকাঙ্খার শহর তখন কেবলই মৃত জোনাকীর থমথমে চোখ। ...কোথায় যাবে সে!

’মৃত্যুর শহর’ মাসকাওয়াথ আহসানের প্রথম উপন্যাস। এক অভিনব স্টাইলে লেখক মুকিতকে নিয়ে গেছেন শহরের পরতে পরতে বিচিত্র সব মানুষদের মনের গোপন কামরায় যেখানে অ্যাফলুয়েন্ট সোসাইটির পলেস্তারা লাগানো জীবনের খাঁ খাঁ শূণ্যতার পাশাপাশি উঠে আসে নিম্ন মধ্যবিত্তের আটোসাঁটো জীবনক্ষরা। সোডিয়াম আলোর বিভ্রম এড়িয়ে পরিশুদ্ধতার প্রত্যয়ে নাগরিক জীবনের এক অনবদ্য আখ্যান ’মৃত্যুর শহর’। টানটান গদ্যে লেখা বইটি প্রকাশ করেছে পড়ুয়া, ৪৫ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।

-রিভিউটি লিখেছেন : আনোয়ার সাদাত শিমুল

"মৃত্যুর শহর" বইটির পিডিএফ ভার্সন এখানে